উজ্জ্বল অধিকারী, বেলকুচি (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি: চয়ন বলেন, ‘খাবারের এ অনলাইন রেস্তোরাঁ মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন অনেক ভালো অবস্থা। শুধু আমার গ্রাম না দূরদূরান্ত থেকে অর্ডার আসে। মাত্র পাঁচ মাসে টিএফসি-তামাই ফুড কার্ট এখন বেলকুচিতে নিজ গ্রামসহ আশপাশের এলাকার সব মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শহর-নগরের রেস্তোরাঁর মুখরোচক পিৎজা, বার্গার, বিরিয়ানি, ফ্রায়েড রাইস প্ল্যাটার, পাস্তাসহ বাহারি মজার সব খাবার এখন পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামেও।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামে মিলছে এ সব স্বাদের খাবার। শহরের নামি-দামি খাবার গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন তিন সহোদরা। কয়েক মাস ধরে চলছে তাদের অনলাইন রেস্তোরাঁ। পাওয়া যায় চাহিদা মতো সব খাবার। তবে অর্ডার দিতে হয় দুই ঘণ্টা আগে।
তামাই গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাকিয়া আফরোজ চয়ন, জুলিয়া আফরোজ নয়ন ও নুসরাত জেরিন অয়ন।
চয়ন জানান, তিন বোন আর মা-বাবাকে নিয়ে তাদের সংসার। বোনদের মধ্যে চয়ন সবার বড়। চয়ন ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার কথা। করোনার কারণে তা হয়ে ওঠেনি৷ নয়ন স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে আর অয়ন ১০ম শ্রেণীতে পড়ে। চয়ন গত বছর মার্চে করোনার লকডাউনের সময় ঢাকা থেকে গ্রামে যান।
বাবার কাপড়ের ব্যবসা। করোনায় কাপড়ের বাজারে চরম ধস নামে। তাই বাবাকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সেই চিন্তায় পড়েন তিন বোন। হাতে নেই বড় কোনো পুঁজি।
করোনার এই সময়ে গ্রামে বসে অলস সময় কাটানো মোটেই ভালো লাগছিল না তাদের। তাই চয়ন প্রথমে অনলাইনে একটি ফেসবুক পেজ খুলে সিরাজগঞ্জের তাঁতকুঞ্জে উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিস বাজারজাত করতে শুরু করেন। কিন্তু এই ব্যবসায় পুঁজির অভাবে খুব একটা লাভবান হতে পারছিলেন না।
তখন হঠাৎ চয়নের মাথায় আসে কীভাবে শহরের মতো গ্রামেও একটি অনলাইন রেস্তোরাঁ চালু করা যায়। তিনি বলেন, যেহেতু গ্রামে খাবারের তেমন ভালো রেস্তোরাঁ নেই, তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানেই একটি অনলাইন রেস্তোরাঁ চালু করলে সাড়া মেলার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাইরে দোকান দিতে তো অনেক অর্থের প্রয়োজন। তা তাদের নেই। তাই ফেসবুক ব্যবহার করে হোম ডেলিভারির চিন্তা ঠিক করা হয়।
সেই চিন্তা থেকেই অনলাইনে পোশাক ব্যবসার পাশাপাশি ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর শুধু গ্রামের মধ্যেই খাবার সরবারাহের জন্য শুরু করেন তামাই ফুড কার্ট-টিএফসি নামের অনলাইন রেস্তোরাঁ। সে থেকে আর পেছনে তাকাতে হচ্ছে না তাদের ।
চয়ন বলেন, ‘অনলাইন খাবারের এ রেস্তোরাঁ মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন অনেক ভালো অবস্থা। শুধু আমার গ্রাম না দূরদূরান্ত থেকে অর্ডার আসে। মাত্র পাঁচ মাসে টিএফসি-তামাই ফুড কার্ট এখন নিজ গ্রামসহ আসপাশের এলাকার সব মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
‘আমার কখনও প্রফেশনালি রান্না শেখা হয়নি৷ ছোটবেলা থেকে রান্নার প্রতি ঝোঁক থেকেই রাঁধতে পছন্দ করি ৷ সেই রান্না দিয়েই আজ স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি করোনার সময়ে পুরো পরিবারকেও সহযোগিতা করতে পারছি। ভবিষ্যতে ব্যবসাটি বড় করবার কাজ চলছে।’
টিএফসিতে বিরিয়ানি, রাইসবোল, পাস্তা, তেহারি, চিকেনফ্রাই, শর্মা, চাইনিজ খাবারসহ নানা ধরনের খাবার অর্ডার অনুযায়ী তৈরি হয়ে থাকে।
চয়ন জানান, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পিৎজা, বার্গার, রাইসবোল। পিৎজা বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ২৭৫ টাকায়, রাইসবোল ৯৯ টাকায়, বার্গার ৯৯ থেকে ১৫০ টাকায়। এ ছাড়া সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন খাবার চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি হয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত খাবারের অর্ডার আসতে থাকে। তবে প্রতিদিন বিকেলে ও প্রতি শুক্রবারে অর্ডার থাকে বেশি। জেলার বেশ কিছু গ্রাম ও শহর থেকে খাবারের চাহিদা আসছে। তবে জনবল কম থাকায় সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না।
চয়নের বাবা অর্ডার অনুযায়ী মোটরসাইকেলে যথাসময়ে খাবার সরবরাহ করে থাকেন। দুই বোন ও মা খাবার প্রস্তুত করতে সহায়তা করেন। পাশাপাশি আরও তিন নারী সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন ।
চয়ন আরও বলেন, ‘গ্রামে বসে শুধু একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইন রেস্তোরাঁ চালিয়ে সফল হওয়া যায়, তা আসলে ভাবতেই অবাক লাগে। উদ্যোক্তা হওয়ার পর নিজেকে স্বাধীন মনে হয়। আগের জীবনটা ছিল ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে। ভেবে ভালো লাগে, আমাদের কারণে আরও কিছু মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন।
‘তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষ এখন অনেকটাই আধুনিক ব্যবসা পছন্দ করছেন। যে কারণে অনলাইনে একটি বিরাট ব্যবসার বাজার তৈরি হয়েছে। নতুন উদ্যোক্তার এই বাজারে অংশ নিলে বেকারত্ব অনেকাংশে কমে যাবে।’
চয়নের বাবা নাসিমুল গণি জুয়েল জানান, বর্তমানে কাপড়ের ব্যবসা অনেক খারাপ। তিন মেয়ের লেখা পড়ার খরচ জোগাতে অনেক হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে মেয়েদের এমন উদ্যোগে এখন সংসার অনেক ভালো চলছে।
প্রতিদিন অনলাইনে অনেক অর্ডারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি যথাসময়ে মোটরসাইকেলে গিয়ে পৌঁছে দিই। খাবার খেয়ে সবাই প্রশংসা করে। আমার অনেক ভালো লাগে। স্বপ্ন আছে ভালো মানের একটা রেস্তোরাঁ দেব।